Print

জগন্নাথ লীলা

আওরঙ্গজেব তখন দিল্লির মসনদে। তাঁর প্রতিনিধি হয়ে শায়েস্তা খাঁ দাক্ষিণাত্য শাসন করছেন। শায়েস্তা খাঁ-র ছেলে নাসর খাঁ তখন কটকের সুবেদার। হিন্দু বিরোধী নাসর খাঁ শ্রীজগন্নাথ মন্দির ধবংস করার ফন্দি আঁটে।

খুরদার রাজা মুকুন্দদেব তখন দণ্ড মুকুন্দপুর শাসনের রাজবাড়িতে বিশ্রাম করছেন। পুরী ও ভুবনেশ্বরকে যুক্ত করেছে জগন্নাথ রোড। ১৬৮০-৮২ খ্রিস্টাব্দেও এই রাস্তাটি বেশ চওড়া ছিল। রাস্তাটির পাশেই মুকুন্দপুর শাসন বা মুকুন্দপুর গ্রাম। গুপ্তচর মারফত নাসর খাঁ রাজা মুকুন্দদেবের খবর পেলেন। এই সময় অতর্কিতে আক্রমণ করে মুকুন্দদেবকে পরাজিত ও বন্দি করা অনেক সহজ। এরপর পুরী অধিকার করতে অসুবিধা হবে না। ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের বসন্তকাল। পিপলিতে সেনাছাউনি ফেললেন নাসর খাঁ। সেখান থেকে মুকুন্দদেবের রাজপ্রাসাদের দূরত্ব মাত্র এক মাইল। নাসর খঁাঁ তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পুরীর দিকে অগ্রসর হচ্ছেন জানতে পেরে রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে পড়েন মুকুন্দদেব। যে কোনও সময় তিনিও বন্দি হতে পারেন। অসহায় মুকুন্দদেব একভাবে জগন্নাথদেবকে ডাকতে লাগলেন।

বসন্তকালে প্রকৃতি অতি মনোরম। পরিষ্কার আকাশ। অল্প অল্প শীত। নাসর খাঁ সামান্য সংখ্যক সেনা নিয়ে রাকের অন্ধকারে মুকুন্দদেবকে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন সকালে তিনি পুরীর উদ্দেশ্যে রওনা হবেন। একবার পুরীতে পৌঁছলে শ্রীজগন্নাথ মন্দির তো তাঁর হাতের মুঠোয়। ওই মন্দির মাটির সঙ্গে মিশিয়ে তবেই তাঁর শান্তি। এরপরই ঘটল সেই অলৌকিক ঘটনা। বসন্তকালে প্রকৃতির এই অদ্ভুত চেহারা বড় একটা দেখা যায় না। সন্ধ্যা থেকে বজ্রগর্ভ মেঘ আকাশে। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকে গোটা আকাশটা ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে। এরপর অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হল। বাজ পড়তে লাগল সমানে। এরকম বৃষ্টি ও বজ্রপাত বহুদিন কেউ দেখেনি। বজ্রপাতে ও প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টিতে নাসর খাঁ-র বেশ কয়েকজন সৈনিক মারা পড়ল। তাঁর সেনাবাহিনীর অনেকেরই বিশ্বাস হল এভাবেই হিন্দু দেবতা জগন্নাথ হয়তো তাদের সাবধান করতে চাইছেন। তাদের মনোবল ভেঙে গেল। পুরী বিজয়ের আর কোনও আগ্রহই রইল না।নাসর খাঁ নিজেও মানসিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়লেন। শ্রীজগন্নাথ মন্দির ধবংস করার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে তিনি কটকে ফিরে এলেন।

দিল্লিতে বসেই আওরঙ্গজেব খবর পেলেন তাঁর সুবেদার নাসর খাঁ শ্রীজগন্নাথ মন্দির ধবংস করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এরপর নবাব ইক্রাম খাঁ-কে কটকের সুবেদার করে পাঠালেন সম্রাট। ইক্রাম খাঁ-কে যেভাবেই হোক শ্রীজগন্নাথ মন্দির ধবংস করার সঙ্গে সঙ্গে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারুমূর্তি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন আওরঙ্গজেব। রাজা দিব্যসিংহদেব তখন শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের প্রধান। তিনি আওরাঙ্গজেবের নির্দেশের কথা জানতে পেরে একটা বুদ্ধি বার করলেন। নিজেই উদ্যোগ নিয়ে দেখা করলেন ইক্রাম খাঁ-র সঙ্গে। দিব্যসিংহদেব তাঁকে কথা দিলেন পুরীর বড় মন্দির নিজের হাতেই ভাঙবেন। এবং তিন বিগ্রহের মূর্তি ভারত সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। দিব্যসিংহদেব বিশ্বাস করলেন। ইক্রাম খাঁ। কিন্তু তাঁর বুদ্ধিমত্তা ধরতে পারেননি।

জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার চন্দনকাঠের তিনটি মূর্তি নির্মাণ করালেন দিব্যসিংহদেব। সেগুলি পাঠিয়ে দিলেন আওরঙ্গজেবের কাছে। আওরঙ্গজেব তখন বিজাপুরে। মূর্তিগুলি নিয়ে আওরঙ্গজেব কী করলেন ? মসজিদের সিঁড়ির পাশে এমনভাবে ফেলে রাখার নির্দেশ দিলেন যাতে আসতে যেতে সেগুলি নামাজ পড়তে আসা লোকদের কোনও না কোনওভাবে পায়ে লাগে। এদিকে, জগন্নাথ, বলভদ্র ওসুভদ্রার আসল মূর্তিগুলিকে কোকোলাগড়ে গোপনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মতান্তরে বিগ্রহ তিনটিকে মা বিমলার মন্দিরের পিছনে লুকিয়ে রাখা হয়। সেখানেই জগন্নাথদেবের পুজো-অর্চনা চলতে থাকে। শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণের গোপন সুড়ঙ্গপথ দিয়ে পূজারিরা বিমলা মন্দিরে আসতেন।

ইক্রাম খাঁ-র বিশ্বাস আনার জন্য মন্দিরের পূর্বদিকে সিংহদরজার খানিকটা অংশ ভেঙে ফেলেন দিব্যসিংহদেব। এদিকে আওরঙ্গজেবের দুই প্রতিনিধি পুরীতে এলেন মন্দির ভাঙার কাজ কতটা এগিয়েছে তা চাক্ষুষ করতে। মন্দির ভাঙার কাজ শুরু হয়েছে দেখে তাঁরা খুশি মনে ফিরে যান। তবে যাওয়ার আগে ভোগমন্ডপের শিখরের সুদর্শন চক্রটি ভেঙে সঙ্গে নিলেন। সম্রাট চক্রটি দেখে খুশি হবেন। নবাব উক্রাম খাঁ-র ভাই জগন্নাথদেবের রত্নসিংহাসনের উপর উঠে সেটিকে অবিরাম পদাঘাত করেন।

শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের এই রত্নসিংহাসন দুর্মূল্য কালো মুগনি পাথরের। আটশো বছরের পুরনো এই পাথরখন্ডটি লম্বায় প্রায় ১৬ ফুট। চওড়া ১৩ ফুট, উচ্চতা ৪ ফুট। মন্দিরের গর্ভগৃহে পাথরের এই বেদির উপরই উপবিষ্ট জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা। পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে এটি সবথেকে পবিত্রতম স্থান। জনশ্রুতি, রত্নসিংহাসনের নিচে এক লক্ষ শালগ্রাম শিলা রয়েছে। এবং বেদির উপর শ্রীমন্ত্র অঙ্কন করে শ্রীবিগ্রহগুলিকে স্থাপন করা হয়েছে। উড়িষ্যার বৈষ্ণব কবিরা এই রত্নসিংহাসনের মাহাত্ম্য নানাভাবে বর্ণনা করেছেন। একে নিত্য গোলকধাম, রাধা-কৃষ্ণের নিত্য লীলাস্থল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সিংহাসনের তিন দিক থেকে দেবতা ও ঋষিদের মূর্তি দেওয়ালে খোদাই করা।

রাজা নরসিংহদেবের বুদ্ধির জোরে শ্রীজগন্নাথ মন্দির সে যাত্রায় রক্ষা পেলেও জগন্নাথদেবের বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে যে জাঁকজমক হত তা বন্ধ করে দেওয়া হল। মাদলাপাঁজি থেকে জানা যায় যে, গর্ভগৃহে রত্নসিংহাসনের উপরেই জগন্নাথদেবের স্নানযাত্রা উৎসবটি সেবার সম্পন্ন হয়। আর তাঁর গুণ্ডিচাযাত্রা অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ভোগমণ্ডপে। সেবার রথযাত্রা না হওয়ায় পুরী শ্রীহীন হয়ে পড়েছিল। জগন্নাথদেবের অন্যান্য উৎসবেও জাঁকজমক বন্ধ। কাঁসর-ঘন্টা, বাদ্যির আওয়াজ নেই। জগন্নাথদেবের পুজো-অর্চনা ও উৎসব নিয়ে কেন এত গোপনীয়তা ? এর একটাই কারণ, আওরঙ্গজেব যদি কোনওভাবে খবর পান যে পুরীর মন্দিরে আগের মতোই পুজো-অর্চনা চলছে তাহলে এই মন্দির রক্ষা করা রীতিমতো কঠিন হবে।

আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে শ্রীজগন্নাথ মন্দির দর্শনের জন্য পুরীতে যেসব তীর্থযাত্রী আসতেন তাঁদের তীর্থকর দিতে হত। এই তীর্থকর থেকে প্রচুর অর্থ রাজ কোষাগারে জমা পড়ত। কিন্তু গন্ডগোলের ভয়ে সেইসময় পুরীতে তীর্থযাত্রীদের সংখ্যা হঠাৎ কমে যায়। ফলে নামমাত্র তীর্থকর আদায় হত। এতে মোঘল সরকারের রাজস্বও কমে গিয়েছিল। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তা দরকার। শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে যাতে নতুন করে কোনও অচলাবস্থার সৃষ্টি না হয় সেদিকেও প্রশাসনের নজর রাখা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে কটকের নায়েব নাজিম মুর্শিদকুলি খাঁ ২য় (১৭৩৫-১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে) যথাযথ ব্যবস্থা নেন। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের পূর্ব-পরিবেশ অনেকখানি ফিরে আসে।