আফগান আক্রমণ

উড়িষ্যার বিভিন্ন রাজাদের রাজত্বে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের কিছু না কিছু শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। রাজারা যুদ্ধবিগ্রহে অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকলেও জগন্নাথদেবের পুজো-অর্চনার ক্ষেত্রে কখনও বাধা বিঘœ আসেনি। শুধু টাকা-পয়সা বা সোনাদানা নয়, এই মন্দিরের নামে জমিজমার পরিমাণও নেহাত কম ছিল না। ক্রমশ তা আরও বেড়েছে। বর্তমানে কটক, খুরদা, জাঠনিসহ সমস্ত উড়িষ্যা রাজ্য জুড়ে জগন্নাথদেবের মোট জমির পরিমাণ ৫৬ হাজার একর যা এক কথায় চমকে দেওয়ার মতোই। তবে উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই বিশাল পরিমাণ জমি বেদখল হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে ‘শ্রীজগন্নাথ মন্দির কমিটিকিছু কিছু জমি ইদানিং বিক্রি করছে। বিক্রির টাকা মন্দির কমিটির নামেই ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রাখা হয়।

১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের মৃত্যুর পর মাত্র আঠাশ বছরের মধ্যে পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের উপর কালাপাহাড়ের আক্রমণ নেমে আসে। সে এক সাংঘাতিক ঘটনা। গোটা পুরী শহর জুড়ে রক্তস্রোত বইয়ে দেয় হিন্দুবিদ্বেষী প্রবল অত্যাচারী কালাপাহাড়।

১৫৬৮ খিস্টাব্দে। জগন্নাথদেবের দোল উৎসব সবে শেষ হয়েছে। এমন সময় মুকুন্দদেব খবর পেলেন বঙ্গদেশের শক্তিশালী সুলতান সুলেমান কররানি উড়িষ্যার বিরুদ্ধে ঝটিকা আক্রমনের জন্য তৈরি হচ্ছেন। আর কিছুদিনের মধ্যে সুলতানের ছেলে বায়াজিদের নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী পৌঁছেও গেল উড়িষ্যার সীমান্তে। বায়াজিদের দুই সেনাপতি কালাপাহাড় ও সিকান্দর উজবেক। মুকুন্দদেব যখন সিকান্দর উজবেকের সঙ্গে তুমুল লড়াই করছেন সেই সময় পুরী সম্পূর্র্ণ অরক্ষিত। তিনি খবর পেলেন কালাপাহাড় কটকের সুরক্ষিত বারবাটি দুর্গটি দখল করেছে। মোঘল সম্রাট আকবর ছিলেন মুকুন্দদেবের বন্ধু। মুকুন্দদেবের আশঙ্কা ছিল কালাপাহাড় পুরী আক্রমনের সুযোগ হাতছাড়া করবেনা। এবং একবার পুরীতে পৌঁছতে পারলে গোটা শহরকে সে ধবংস¯তূপে পরিণত করবে। পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দির তার হাত থেকে রক্ষা পাবে না। মুকুন্দদেব পুরীকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। বন্ধুবর দিল্লীশ্বর আকবরের কাছে সাহায্য চাইলেন। কিন্তু রাজস্থানে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় মুকুন্দদেবকে কোনও সাহায্যই করতে পারেননি আকবর। পুরী অরক্ষিত অবস্থায় রয়ে গেল। উড়িষ্যার জাজপুর থেকে চার মাইল দূরে গোহিরা টিকিরি নামে এক জায়গায় মুকুন্দদেব যুদ্ধ করতে করতে বীরের মতো মৃৃত্যুবরণ করেন। শোনা যায় তাঁরই সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় মুকুন্দদেবের মৃৃত্যু হয়। উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন রাজা তিনি। ওত পেতে ছিল কালাপাহাড়। কটক থেকে রাতারাতি সৈন্যবাহিনী ছুটিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুরীর উপর। সূর্র্যের আলোয় কালাপাহাড়ের শাণিত তরবারি চকচক করে উঠল।

কেন পুরী ও পুরীর জগন্নাথদেবের উপর কালাপাহাড়ের এর রাগ ? শোনা যায় একসময় গোঁড়া হিন্দু কালাচাঁদ সুলতান সুলেমান কররানির নির্দেশে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। মুসলমান ধর্ম নেওয়ার পর কালাচাঁদ সুখী ছিল না। দুই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে একবার সে পুরীতে এল জগন্নাথ দর্র্শনের জন্য। জগন্নাথদেবের আর এক নাম পতিতপাবন। হিন্দুশাস্ত্র অনুসারে জগন্নাথ দর্র্শনে সবরকম পাপ দূর হয়। কালাচাঁদেরও আশা ছিল শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে এসে সে পাপমুক্ত হবে।

মুক্তিমন্ডপের পন্ডিতদের কাছে হাতজোড় করে ধর্ম পরিবর্র্তনের পাপ স্বীকার করেছিল কালাচাঁদ। এর প্রায়শ্চিত্ত কী তা বলে দেওয়ার জন্য পন্ডিতদের অনুরোধও করে সে। কিন্তু কালাচাঁদ মুসলমান একথা জানতে পেরে মুক্তিমন্ডপের পন্ডিতরা তাকে কটু ভাষায় অপমান করেন। এবং মূল মন্দিরে ঢুকতে বাধা দেয়। এরপর কালাচাঁদ না কি মাটিতে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করেছিল জগন্নাথ দর্শনে তাকে যেন অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু মুক্তিমন্ডপের পন্ডিতরা তার কথায় কর্ণপাত করেননি। বরং বিধর্মী কালাচাঁদকে উপর্যুপরি লাথি মারতে থাকে। কালাচাঁদের দুই স্ত্রী এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালে তাঁরাও অপমানিত হন।

আর ধৈর্য ধরে থাকা সম্ভব হয়নি কালাচাঁদের। সে উঠে দাঁড়ায় এবং সকলের সামনে ঘোষণা করে, “ জগন্নাথদেব তাহলে করুনার আধার নয়। সেরকম হলে আজ তাকে এত অপমান সহ্য করতে হত না। কাছাড়া এই মন্দিরের পূজারিদের আচার-আচরণও ভালো নয়। মানুষকে বিপথে চালিত করাই তাঁদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এমন একদিন আসবে জগন্নাথের বিগ্রহসহ গোটা মন্দিরকে আমি ধবংস¯তূপে পরিণত করব।তবে কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে কালাপাহাড় নাকি পুরীর মন্দিরে কখনও আসেননি। কবে বিধর্মী সম্বন্ধে এই মন্দিরের রুদ্ধদ্বার মনোভাব বারেবারেই প্রমাণিত। শোনা যায় পার্শীকে বিয়ে করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাও এখানে প্রবেশাধিকার পাননি।

সে যাই হোক, পুরীতে পৌঁছেই যথেচ্ছভাবে হিন্দুমন্দির ভাঙতে শুরু করে কালাপাহাড়্ মন্দির ভাঙার মধ্যে দিয়েই সে তার মানসিক শান্তি খুঁজে পেত। শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের দিকে কালাপাহাড় ধেয়ে আসছে শুনে মন্দিরেরই দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজপ্রতিনিধি দিব্যসিংহ পট্টনায়ক জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার বিগ্রহকে চিলকা হ্রদের ভেতরে ছাপলি হাতিপাড়া নামে একটি ছোট্ট দ্বীপে লুকিয়ে রাখেন।

ঐতিহাসিক নিয়ামতউল্লার ‘মাখজান-ই-আফগানগ্রন্থে কালাপাহাড়ের শ্রীজগন্নাথ মন্দির আক্রমনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। কালাপাহাড় সৈন্যসামন্ত নিয়ে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করল। কিন্তু জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারুমূর্তি তার নজর পড়ল না। কালাপাহাড়ের বুঝতে বাকি রইল না যে বিগ্রহ তিনটি কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে। পুরী জেলার ব্রহ্মগিরি অঞ্চলের গড় কোকালা নামে এক গ্রামের প্রধান দনপাহন্ত সিমহা জানতেন সেই ছাপলি হাতিপাড়া গ্রামের কথা। তিনিই কালাপাহাড়কে জায়গাটি চিনিয়ে দেন। বিশ্বাসঘাতক দনপাহন্তকে পুরী জেলায় দুটি বড় জায়গির দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন কালাপাহাড়। খুরদায় আবি®কৃত তালপাতার পুঁথিতে কালাপাহাড়ের পুরী আক্রমণের উল্লেখ রয়েছে। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি-তেও এই জঘন্য আক্রমণের কথা জানা যায়।

এরপর জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার বিগ্রহ তিনটিকে সর্বসমক্ষে হাতির পিঠে চাপিয়ে পুরীতে নিয়ে এল কালাপাহাড়। কেন বিগ্রহগুলিকে হাতির পিঠে চাপানো হয়েছিল তার উত্তর সোজা। কালাপাহাড় উড়িষ্যাবাসীকে তার ক্ষমতা দেখাতে চেয়েছিল। উড়িষ্যা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর সর্বশক্তিমান জগন্নাথদেবও তার হাতে বন্দি।

জগন্নাথদেবের অলংকারগৃহ ‘ভাণ্ডারানামে পরিচিত। সেই ভাণ্ডারা তছনছ করে ফেলে কালাপাহাড়। আজকের হিসেবে কয়েক কোটি টাকার স্বর্ণালংকার ও হিরে-জহরত লুট করেছিল সে। মন্দিরের নীচের অংশও তার সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গোটা মন্দিরকে ধূলিসাৎ করার চেষ্টা করেছিল কালাপাহাড়। কিন্তু বিশেষ ধরনের হালকা-গোলাপি উৎকৃষ্ট ‘ খোন্ডালাইটপাথরে নির্মিত অত্যন্ত শক্তপোক্ত এই মন্দিরকে চূর্ণবিচূর্ণ করা কালাপাহাড়ের মতো এক মন্দির ধবংসকারীর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। মন্দির ধবংস করতে না পেরে রাগে অন্ধ কালাপাহাড় মন্দিরের গায়ে বেশ কিছু অমূল্য ভাস্কর্যের ক্ষতি করেছিল।

মুক্তিমন্ডপের পাশেই ছিল পবিত্র কল্পবট। স্কন্দপুরাণ ও অন্যান্য পুরাণে এই কল্পবটের পবিত্রতার কথা বলা হয়েছে। ভগবান বিষ্ণু তথা শ্রীজগন্নাথদেবের প্রতীক হল কল্পবট। একথা জানতে পেরে গোটা বটগাছটি গোড়াসুদ্ধ উৎপাটন করেছিল কালাপাহাড়। তারপর গাছটিকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারুমূর্তি কালাপাহাড় তার সঙ্গেই নিয়ে যায়। এবং গঙ্গার ধারে আগুন জ্বালিয়ে তাতে বিগ্রহ তিনটিকে ছুঁড়ে ফেলে। এরপর অর্ধদগ্ধ বিগ্রহগুলিকে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়। বিসরা মহান্তি নামে এক সাহসী জগন্নাথভক্ত ছদ্মবেশে কালাপাহাড়কে অনুসরণ করেছিলেন। তিনিই জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার ‘ব্রহ্মউদ্ধার করে উড়িষ্যার কুজঙ্গগড় নামে এক জায়গায় খুব হোপনে নিয়ে যান। সেখানে ‘ওলিয়া-র উপর এই ব্রহ্মগুলির অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো-অর্চনা শুরু হয়। ওলিয়া হল খড়ের তৈরি আসন।

মুকুন্দদেবের মৃত্যুর পর উড়িষ্যা আফগান সেনাদের হাতে আসে। ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে আফগানদের পরাজিত করে উড়িষ্যা অধিকার করেন মোঘল সম্রাট আকবর। ১৫৬৮ থেকে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ২৪ বছর কিন্তু শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার কোনও বিগ্রহ ছিল না। আফগানদের অত্যাচারে পুরীতে পুজো আর্চাই বন্ধ হয়ে যায়। এরপর খুরদার রাজা রামচন্দ্রদেব সম্ভবত সম্রাট আকবরের একান্ত বিশ্বাসভাজন মোঘল সেনাপতি ও অর্থমন্ত্রী টোডরমলের সাহায্যেই উড়িষ্যায় তাঁর নতুন রাজ্য স্থাপন করেন এবং শ্রীজগন্নাথদেবের বিগ্রহকে শ্রীমন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। ইতিমধ্যে আকবরের নির্দেশে রাজা মানসিংহও উড়িষ্যায় এসে উপস্থিত হন। শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের উন্নয়ন শ্রীজগন্নাথদেবের পুজো-অর্চনার ব্যাপারে মানসিংহ যথেষ্ট যত্নবান ছিলেন। আকবরের সময়ে শ্রীজগন্নাথ মন্দির পুজো-অর্চনা, ভোগ ইত্যাদি সবকিছুই সুষ্ঠুভাবে চলছিল। ঔরঙ্গজেবের আমলে উড়িষ্যায় প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ হয়। সেই সময় এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের দৈনন্দিন পুজো-অর্চনার উপরও পড়েছিল। বিশেষ করে মন্দিরে ভোগের পরিমাণ তখন অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়।