অলৌকিক ঘটনা
শ্রীজগন্নাথদেবকে নিয়ে কতগুলি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল উড়িষ্যার সূর্যবংশের রাজা কপিলেশ্বরদেব বা কপিলেন্দ্রদেবের সময়ে। গঙ্গবংশের শেষ রাজা নিষঙ্কভানু চতুর্থ। তারপর উড়িষ্যায় সূর্যবংশের রাজত্বের শুরু। পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের গায়ে রাজা কপিলেশ্বদেবের কিছু লিপি পাওয়া গিয়েছে। তাতে জানা যায় জগন্নাথের প্রতিভূ হিসেবেই রাজ্যশাসন করতেন তিনি। রাজ্যশাসনের ৩৫-তম বছরে কয়েকজন সামন্ত প্রধান কপিলেশ্বদেবের বিরুদ্ধে হঠাৎ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁদের সমুচিত শাস্তি দেওয়ার জন্য জগন্নাথের আজ্ঞা চাইলেন কপিলেশ্বর। ছুটে গেলেন পুরীর মন্দিরে। সারাদিন মন্দিরেই কাটল তাঁর। জগন্নাথের আজ্ঞা গ্রহণের আশায় ঘন্টার পর ঘন্টা মাথা নিচু করে চুপচাপ বিগ্রহের সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিলেন চিন্তাক্লিষ্ট কপিলেশ্বরদেব। রাতে যখন মন্দিরের দরজা বন্ধ হল সেখান থেকে বেরলেন। এরপর বিদ্রোহী সামন্ত প্রধানদের অনায়াসেই দমন করেন তিনি।
উড়িষ্যাবাসীদের মনে সন্দেহ রইল না যে জগৎপিতা শ্রীজগন্নাথদেবের মহিমাতেই রাজা কপিলেশ্বরদেবের এই বিজয়লাভ সম্ভব হয়েছে।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের মূল দরজার বাইরে বাঁদিকে রাজা কপিলেশ্বরদেবের যে কথা খোদাই করা ছিল তাতে তিনি বলেছেন, ‘হে প্রভু জগন্নাথ। আমার মনের সমস্ত খবরাখবর কিছুই আপনার অজানা নয়। আপনি যে অন্তর্যামী। আমার কাছে যা কিছু দুর্মূল্য বস্তু রয়েছে তার যতটা সম্ভব ব্রাহ্মণদের দান করব আমি। হে ঈশ্বর, যাকে আপনি দয়া করে এত সম্পদ দান করেছেন তা তো আপনারই সব’। দেখা যাচ্ছে কাউকে কিছু দান করতে হলেও জগন্নাথদেবের অনুমতি নিচ্ছেন কপিলেশ্বরদেব। ওড়িয়া ভাষায় লেখা তাঁর আরও কিছু লিপি পাঠোদ্ধার করা হয়। এরকমই একটিতে তাঁর বিশেষ ঘোষণা-‘‘আজনা ভোলি হৈলা আমার উড়িষ্যা রাজ্যে এতি রাজা মূলা। সবুহেন রাজঙ্কু অনাহিতে ভ্রাতিয়ে রাজা ভাহরাকারি তাহারা সর্বস্ব হরি।।” অর্থাৎ ‘‘উড়িষ্যায় যে রাজারা রাজত্ব করছেন তাঁদের প্রত্যেকেরই এই সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কাজ করে যাওয়া উচিত। প্রত্যেক রাজারই অন্যায়ের পথ পরিত্যাগ করে ন্যায়ের পথে চলা উচিত। আর কেউ যদি সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যত্নবান না হন রাজ্য থেকে তাঁকে বিতাড়িত করতে হবে।” এরকম ঘোষণা-লিপি পুরীর মন্দিরের গায়ে খোদাই করা হয়েছিল যা ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটু অন্যরকম ব্যাপার তো বটেই।
১৪৫৮ খ্রিস্টাব্দ। কপিলেন্দ্রদেব তখন ক্ষমতা ও উন্নতির শিখরে। কিন্তু যুবরাজ কাকে করবেন তা নিয়ে তিনি বেজায় চিন্তিত। উপযুক্ত যুবরাজ নির্বাচন করতে না পারলে রাজ্যেরই অমঙ্গল। কপিলেশ্বরদেবের দুই রানি। পাটরানির আঠারোটি ছেলে। ছোটরানির একটি। মোট উনিশজন ছেলের মধ্যে একজনই যুবরাজ হবেন। আর তা নিয়ে ছেলেদের মধ্যে প্রচন্ড রেষারেষি। ছোটরানির ছেলে পুরুষোত্তমই একটু অন্য ধরনের। রাজা হওয়ার লোভ তাঁর নেই। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতেন শ্রীজগন্নাথদেবের আশীর্বাদেই পুরুষোত্তম জন্মগ্রহণ করেছেন। এবং সেজন্যই তাঁর নাম পুরুষোত্তম রাখা হয়েছে।
কিংবদন্তি এরকম, জগন্নাথদেবের কাছে হত্যে দিয়ে পড়লেন কপিলেন্দ্রদেব। যুবরাজ নির্বাচনের ব্যাপারে আরাধ্য দেবতা যেন তাঁকে সঠিক পথের সন্ধান দেন। একদিন রাতে রাজা ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলেন। জগন্নাথদেব তাঁকে বলছেন, ‘পাটরানির ছেলেরা নয়, যুবরাজ হিসেবে পুরুষোত্তমই সবথেকে উপযুক্ত।’ এরপর পুরুষোত্তমকেই যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করেন কপিলেশ্বরদেব। শোনা যায় এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ পাটরানির ছেলেরা পুরুষোত্তমকে তীর ছুঁড়ে হত্যার চেষ্টা করেন। তিনি অলৌকভাবে বেঁচে যান। কিংবদন্তি যা-ই হোক, উড়িষ্যাবাসীর বিশ্বাস যখনই এখানকার কোনও রাজা রাজ্যশাসন বা অন্য ব্যাপারে বিরাট অনুবিষেয় পড়েন জগন্নাথদেবের কাছে তিনি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেন। আর সেই প্রার্থনায় সাড়া দেন স্বয়ং জগন্নাথ। স্বপ্নাদেশ দেন। মাদলাপাঁজিতেও একথা বলা হয়েছে। এবং এই স্বপ্নাদেশ খন্ডপাল ও সামন্তদেরও মেনে নিতে হয়েছে।
১৪৬৭ খ্রিস্টাব্দে পুরুষোত্তমদেব রাজ্যশাসন শুরু করেন। শ্রীজগন্নাথদেবের দৈনন্দিন পুজোর জন্য তিনি যা অর্থ ও জমিজমা দান করেছেন ইতিপূর্বে উড়িষ্যার কোনও রাজাই তা করেননি। শ্রীজগন্নাথদেবের প্রতি রাজা পুরুষোত্তমের এতটাই শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল যে তিনি ঘোষণা করেন- ‘জগন্নাথদেবের প্রতি যদি কেউ বিন্দুমাত্র আনুগত্যপ্রকাশে ইতঃস্তত করেন তাকে মহাপাতক বলেই মনে করা হবে।’
শ্রীজগন্নাথদেবকে নিয়ে তৃতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল পুরুষোত্তমদেবের রাজত্বকালেই যার হুবাহু বর্ণানা রয়েছে মাদলাপাঁজিতে। একবার জগন্নাথদেবের রথযত্রার সময় কাঞ্চির রাজা শল্য নরসিংহকে পুরীতে নিমন্ত্রণ করেন পুরুষোত্তমদেব। এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে যেভাবে মেতে ওঠে উড়িষ্যাবাসী তা সচক্ষে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন শল্য নরসিংহ।
রথযাত্রার দিন জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার রথ পুরুষোত্তমদেবকে সোনার ঝাড়– দিয়ে পরিষ্কার করতে দেখে কাঞ্চিরাজ খুব আশ্চর্য হয়ে যান। রাজা হয়েও একজন ঝাড়–দারের মতো আচরণ ? উড়িষ্যার রাজার সঙ্গে মেয়ে পদ্মাবতীর বিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন কাঞ্চিরাজ। কিন্তু এবার ভাবলেন, পুরুষোত্তমদেবের আতিথ্য গ্রহণ করে তিনি বিরাট ভুলই করেছেন। রথযাত্রার পরদিনই পুরুষোত্তমদেবকে কিছু না জানিয়ে কাঞ্চিতে ফিরে গেলেন রাজা। অবশ্য যাওয়ার আগে উড়িষ্যারাজ্যের প্রধানমন্ত্রীকে বলে গেলেন পুরুষোত্তমদেবের সঙ্গে তিনি মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন না: ‘একজন চন্ডালের সঙ্গে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেবো না।’
গোটা ঘটনাটি পুরুষোত্তমদেবকে জানানো হল তিনি তো রেগে আগুন। ১৪৭৬-৭৭ খ্রিস্টাব্দ। কাঞ্চির বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করলেন পুরুষোত্তমদেব। প্রথমবার হেরে যান তিনি। দ্বিতীয়বার কাঞ্চি রাজার বিরুদ্ধে আবার সেনা অভিযান পুরুষোত্তমদেবের। ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হল। হঠাৎ দেখা গেল পুরুষোত্তমদেবের সেনাবাহিনীর দুই অশ্বরোহী সৈনিক বীরবিক্রমে যুদ্ধ করছেন। একজন কালো ঘোড়ার পিঠে অন্যজন সাদা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার। তাঁদের আক্রমণে কাঞ্চির সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছিল। পুরুষোত্তমদেবের সেনাপতিও এই দুই সৈনিককে ঠিক চিনতে পারলেন না। যুদ্ধে জয় হল পুরুষোত্তমদেবের। ওই দুজন সৈনিকের খোঁজ করা হল। কিন্তু তাঁদের খুঁজে পাওয়া গেল না। পুরুষোত্তমদেব তো বটেই, উড়িষ্যাবাসী প্রত্যেকেরই বদ্ধমূল ধারণা হল, এরকম অলৌকিক ঘটনা একমাত্র জগন্নাথদেবের কৃপাতেই সম্ভব। কালো ঘোড়ার পিঠে জগন্নাথদেব ও সাদা ঘোড়ার পিঠে বলভদ্র সৈনিকের ছদ্মবেশে যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন পুরুষোত্তমদেবকে সাহায্য করতে। শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের নাটমন্দির ও ভোগমন্ডপের দেওয়ালে রাজা পুরুষোত্তমদেবের কাঞ্চি-বিজয়ের এই কাহিনি বর্ণিত আছে। তা গুন্ডিচা মন্দিরের দেওয়ালেও রয়েছে।
কাঞ্চি অধিকার করলেন পুরুষোত্তমদেব। রাজকুমারী পদ্মাবতীকে বন্দি করে উড়িষ্যায় নিয়ে এলেন। কাঞ্চিরাজের আরাধ্য দেবতা কাঞ্চিগণেশ ও সাক্ষীগোপালের দুটি অপূর্ব সুন্দর পাথরের মূর্তিও নিজের রাজ্যে নিয়ে এসেছিলেন পুরুষোত্তমদেব। প্রায় সোয়া পাঁচশো বছরের পুরনো কাঞ্চিগণেশের কষ্টিপাথরের এই বিশাল মূর্তিটি আজও পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দির প্রাঙ্গণে গণেশ মন্দিরে পূজিত হচ্ছে। কাঞ্চিগণেশের আর এক নাম ‘ভন্ড গণেশ।’ কেন ভন্ডগণেশ তা পরে জানতে পারব। মন্দিরটি পশ্চিম দ্বারপ্রান্তে ।সাক্ষীগোপালের মূর্তিটিকে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের ভোগমন্ডপে রেখে তাঁর পুজো-অর্চনা চলছিল। পরে পুরুষোত্তমদেব এক স্বপ্নাদেশ পেয়ে সাক্ষীগোপালের মূর্তিটিকে পুরী থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে গুপ্ত বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দেন। এই অঞ্চলটিই এখন ‘সাক্ষীগোপাল’ নামে খ্যাত।
পুরুষোত্তমদেব প্রতিজ্ঞা করেন সত্যিকারের এক ঝাড়–দার চন্ডালের সঙ্গেই পদ্মাবতীর বিয়ে দেবেন। তিনি এ কাজের দায়িত্ব তাঁর প্রধানমন্ত্রীর হাতে সঁপলেন। মাসখানেক পরেই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। রথযাত্রার দিন পুরুষোত্তমদেব যখন নিয়মমাফিক জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার রথ সোনার ঝাড়– দিয়ে পরিষ্কার করছিলেন ঠিক সেই সময়ে পদ্মাবতীকে সঙ্গে করে রাজার সামনে এসে উপস্থিত হলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি পুরুষোত্তমদেবকে অনুরোধ করলেন পদ্মাবতীকে বিয়ে করতে। কারণ, পুরুষোত্তমদেবই হলেন উড়িষ্যার সবথেকে বড় ‘ঝাড়–দার চন্ডাল।’ এবং প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী রাজকুমারী পদ্মাবতীকেই পুরুষোত্তমদেবের বিয়ে করা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর বুদ্ধির তারিফ করলেন রাজা। এবং অত্যন্ত খুশি মনেই পদ্মাবতীকে বিয়ের প্রস্তাবটি তিনি গ্রহণ করলেন। তাঁদেরই ছেলে গজপতি রাজা প্রতাপরুদ্রদেব ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার রাজা হন। এই প্রতাপরুদ্রদেবের সময়েই শ্রীচৈতন্যদেব পুরীতে আসেন।
শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রাজা পুরুষোত্তমদেবের আমলেই হয়েছিল। রাজ্যশাসনের সপ্তম বছরে তিনি ভোগমন্ডপটি তৈরি করেন। নাটমন্দিরের লাগোয়া এই ভোগমন্ডপ। উড়িষ্যার মন্দিরের স্থাপত্যরীতিই এরকম যে, বিমান বা গর্ভগৃহের লাগোয়া মন্দিরের আরও তিনটি কক্ষ থাকবে যথাত্রমে জগমোহন, নাটমন্দির বা নৃত্যমন্ডপ ও ভোগমন্ডপ। মোট চারটি অংশ নিয়েই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মন্দির গড়ে ওঠে। উড়িষ্যার বেশির ভাগ মন্দিরের নির্মাণশৈলী সাধারণত রথের মতো। অতএব রাজা পুরুষোত্তমদেব ভোগমন্ডপটি তৈরি করার পরই জগন্নাথ মন্দির যা এতদিন একটি পরিপূর্ণ রূপ পাওয়ার অপেক্ষায় ছিল তা সম্পূর্ণ হয়। ততদিনে পুরীর মন্দির এদেশের হিন্দু তীর্থযাত্রীদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
রাজা পুরুষোত্তমদেবের আমলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিন বহু তীর্থযাত্রী পুরীতে শ্রীজগন্নাথ দর্শনে আসতেন। তীর্থযাত্রীরা খাবেন কী ? জগন্নাথদেবের ভোগ যা মহাপ্রসাদ নামে পরিচিত তা সমস্ত তীর্থযাত্রীকে খায়ানোর জন্যই একটি ভোগমন্ডপ তৈরির প্রয়োজনীয়তা পুরুষোত্তমদেবই প্রথম অনুভব করেন। ভোগ রাঁধার জন্য রান্নাঘরও দরকার।রাজত্বের নবম বছরে মন্দিরের দক্ষিণ দ্বারপ্রান্তের লাগোয়া অনেকটা জায়গা জুড়ে একটি বিশাল বড় রান্নাঘর তৈরি করালেন পুরুষোত্তমদেব। একে জগন্নাথদেবের পাকশালা বলে। আজও এই পাকশালা একটি দর্শনীয় জায়গা। শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের উন্নয়নের ব্যাপারে বাবার পদাঙ্কই অনুসরণ করেছিলেন পুরুষোত্তমদেব। কারণ, রাজা কপিলেন্দ্রদেব তাঁর রাজত্বের পঞ্চদশ বছরে এই মন্দিরের চারদিকে একটা উঁচু প্রাচীর তৈরি করেন। বাইরের শত্রুদের হাত থেকে মন্দিরকে রক্ষা করার জন্যই এই প্রাচীর তৈরি হয়। বস্তুত এই প্রাচীরের জন্যই শ্রীজগন্নাথ মন্দির অনেকটা দুর্গের রূপ নেয় ও আরও সুরক্ষিত হয়ে ওঠে। এর নাম ‘মেঘনাথ প্রাচীর।’ কপিলেন্দ্রদেব আরও একটি কাজ করেছিলেন। জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে প্রচুর মণি-মুক্তো ও স্বর্ণলংকার দিয়ে সাজিয়েছিলেন। পরবর্তী রাজারাও তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।
রাজা প্রতাপরুদ্রের সময়ে পুরীর জগন্নাথধাম তীর্থযাত্রীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। এর অন্যতম কারণ অবশ্য মহাপ্রভু চৈতন্যদেব। শ্রীজগন্নাথ দর্শন ও মহাপ্রভুর সান্নিধ্যলাভ একই তীর্থক্ষেত্রে, এটাই তীর্থযাত্রীদের পরমপ্রাপ্তি। মাদলাপাঁজি অনুযায়ী শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের গোটা প্রাঙ্গণ প্রতাপরুদ্রদেবই পাথর দিয়ে নতুন করে বাঁধিয়ে দেন এবং দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীদের জন্য মন্দির চত্বরেই তিনি একটি বিশ্রামকক্ষও তৈরি করে দেন।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার বিগ্রহের সামনে প্রতিদিন নিয়মিত কবি জয়দেব ‘গীতগোবিন্দ’-এর অমৃতময় শ্লোক পাঠ করা শুরু হয়। গীতগোবিন্দ পাঠের এই নির্দেশ মাদলাপাঁজি অনুযায়ী গঙ্গবংশের রাজা নরসিংহদেব দ্বিতীয়ই প্রথম দেন। পরে রাজা পুরুষোত্তমদেবের আমলে সংস্কৃতে ‘অভিনব গীতগোবিন্দ’ রচিত হয়। এবং এই অভিনব গীতগোবিন্দের কিছু কিছু শ্লোক মূল গীতগোবিন্দের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন পুরীর মন্দিরের পূজারিরা। কিন্তু স্বয়ং জগন্নাথদেব রাজাকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে এ কাজ করতে বলেছেন একথাই তখন প্রচার করা হয়েছিল। তবে রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের লিপি থেকে জানা যায় যে তিনি কড়া নির্দেশ জারি করেন যে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার সামনে জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দের শ্লোক ছাড়া আর কিছু পাঠ করা যাবে না। রাজ্যশাসনের নবম বছরে কোনও এক বুধবার শ্রীজগন্নাথ মন্দির নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন তিনি। ঘোষণাটি হল এই-শ্রীজগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার ভোগের সময় প্রতিদিন নৃত্যগীত পরিবেশন করা হবে নাটমন্দিরে। সন্ধ্যাধূপ থেকে শুরু করে এই বিগ্রহের ‘বড়শৃঙ্গার বেশ’ পর্যন্ত টানা কয়েকঘন্টা নৃত্যগীত চলবে। বড়শৃঙ্গার বেশের পর জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা শয়ন করেন।
ঠাকুর বিশেষ করে যদি তিনি হন কৃষ্ণ তবে তো নাচ-গান পছন্দ করবেনই। কৃষ্ণই জগন্নাথ। ভারতবর্ষের বহু মন্দিরে দেবদাসী প্রথা তখন ভীষণভাবে রয়েছে। পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দিরও তার বাইরে নয়। দেবদাসীরা নৃত্য-গীতে জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রাকে আনন্দদান করতেন। চারজন বৈষ্ণব গায়কও ছিলেন যাঁরা গীতগোবিন্দের গান শুধু গাইতেন সমবেত কন্ঠে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরেও দেবদাসী প্রথা উঠে যায়।
পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের গায়ে খোদাই করা লিপি থেকে জানা যায় যে গজপতি রাজা প্রতাপরুদ্রদেবের রাজত্বের সময় চার শ্রেণির বৈষ্ণব শ্রীমন্দিরে নামসংকীর্তন করতেন। ‘বড়শৃঙ্গার বেশ’ অনুষ্ঠান চলাকালীন এই নামসংকীর্তন হত। সেই সময় পুরীতে চার সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবের বাস। আজও চার সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবকে দেখা যায় যাঁরা শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত। এঁরা হলেন রামানুজপন্থী, বিষ্ণুস্বামী পন্থী, মাধবপন্থী ও গৌড়ীয় পন্থী। গঙ্গবংশের রাজাদের রাজত্বের সময়েই বিভিন্ন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের আচার্যরা পুরীতে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিষ্ণুস্বামী, নিম্বাকাচার্য, বল্লভাচার্য বা মাধবাচার্যের প্রশিষ্য নরহরি তীর্থ অন্যতম। কবি ও দার্শনিক নরহরি তীর্থ বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্রস্থল শ্রকিূর্মক্ষেত্রে কিছুদিন বসবাস করেন। পুরীর আর এক নাম শ্রীকূর্মক্ষেত্র কারণ এই অঞ্চল কূর্ম অর্থাৎ কচ্ছপের পিঠের মতো। রাজা নরসিংহ দ্বিতীয় তখন খুবই ছোট। তাঁরই প্রতিভূ হিসাবে কয়েক বছর উড়িষ্যা শাসন করেন নরহরি তীর্থ।
চৈতন্যদেবের সময়েই উড়িষ্যায় অন্য এক ধারার বৈষ্ণব ধর্মের সূচনা হয়েছিল। এর প্রবক্তা ছিলেন বলরাম, জগন্নাথ, অচ্যুতানন্দ, যশোবন্ত ও অনন্ত নামে পাঁচজন বৈষ্ণব। তাঁরা ‘পঞ্চসখা’ নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁদের সাধনমার্গকে ‘জ্ঞানমিশ্র ভক্তিবাদ’ বলা হয়। এঁরা জগন্নাথদেবকেই পরিপূর্ণ পরমতত্ত্বরূপে গ্রহণ করেছিলেন। কৃষ্ণসমেত সমস্ত অবতার জগন্নাথদেবেরই কলাবিশেষ বা অংশাবতার। অতএব পুরুষোত্তমক্ষেত্র হচ্ছে নিত্যক্ষেত্র। অন্য ধর্মীয় ক্ষেত্রগুলির উৎপত্তি এই ক্ষেত্র থেকেই হয়েছে। যোগবলে যটচক্রভেদ প্রণালিতে পরমব্রহ্মরূপী জগন্নাথকে লাভ করা যেতে পারে।
গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের থেকে এঁদের মহামন্ত্র, গায়ত্রী ও প্রমাণগ্রন্থ সব আলাদা। সেজন্য পঞ্চসখা দ্বারা প্রবর্তিত ‘ওড়িশি বৈষ্ণবধর্ম’ কিছু কিছু ক্ষেত্রে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধারা থেকে আলাদা। ওড়িশি বৈষ্ণবধর্মের বিভিন্ন রচনাবলী ওড়িয়া সাহিত্যকেও যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে। জগন্নাথদেব বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবতারূপে পূজিত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে পুরীর স্থানীয় বাসিন্দাদের অজানা অনেক নিয়ম নীতিই জগন্নাথদেবের পুজো-অর্চনার ভেতরে ঢুকে পড়ে।
পুরীর শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে ‘কুদুয়া’ নামে একটি শব্দ ব্যবহৃত হয়। এর অর্থ মাটির পাত্রে রান্না করা অন্ন যা মন্দিরে ভোগ হিসেবে নিবেদিত হয়। দ্রাবিড় ভাষা থেকে ‘কুদু’ শব্দটি এসেছে যার মানে সেদ্ধ ভাত। তেমনই কৈলিবৈকুন্ঠ’-একটি দ্রাবিড় শব্দ। কৈলি বা কোয়েল মানে মন্দির। এই শব্দগুলো শ্রীজগন্নাথ মন্দিরেউচ্চারিত হত না যদি না এই মন্দিরের উপর দ্রাবিড় মানুষদের একটা অধিকার থাকত।
এবার জগন্নাথদেবকে নিয়ে আরও কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার কথা বলি। বহুদিন আগেকার কথা। উড়িষ্যার বালিগাঁও গ্রামে দাসিয়া বাউরির বাস। তখনকার দিনে খুব নিচু জাতের লোকজন শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করতে পারত না। গাঁয়েরই কয়েকজন ব্রাহ্মণ পুরীতে যাচ্ছেন শুনে জগন্নাথদেবকে নিবেদনের জন্য তাঁদের হাতে একটি নারকেল দেয় দাসিয়া বাউরি। জগন্নাথের পুজো -অর্চনার পর সেই ব্রাহ্মণরা যখন শ্রীমন্দির থেকে বেরচ্ছেন হঠাৎ একজনের দাসিয়া বাউরির দেওয়া নারকেলের কথা মনে পড়ে। আবার জগন্নাথদেবের গর্ভগৃহে ফিরে যান তাঁরা। একজন সেই নারকেলটি ভেঙে রত্নবেদির উপর রাখতেই সেটি আপনাআপনিই জগন্নাথদেবের বিগ্রহের ঠিক সামনে গড়িয়ে চলে যায়। আস্ত নারকেল হলে তবু বোঝা যেত। কিন্তু সমতল জায়গায় ভাঙা নারকেল গড়াবে কী করে। এই অলৌকিক ঘটনার কথা পুরীর রাজার কানেও পৌঁছল। এরপর তিনি দাসিয়ার মতো এক জগন্নাথ ভক্তকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে পুরীতে নিয়ে এলেন। রথযাত্রার সময় জগন্নাথদেবকে ফুল ও ফল নিবেদন করেন দাসিয়া বাউরির বংশধররা।
দ্বিতীয় অলৌকিক ঘটনাটি এরকম- উড়িষ্যার সুবেদার লাল বেগ একবার এক সুন্দরী বিধবা রমণীকে পুকুরে স্নান করতে দেখে আকৃষ্ট হন। তাকে জোর করে বিয়ে করেন লাল বেগ। তাদের ছেলে সাল বেগ বীর ছিলেন। একবার যুদ্ধে প্রচণ্ড আহত হলেন। তাঁর মা বললেন, ‘জগন্নাথদেবকে তুই একমনে ডাক। দেখবি তাঁর কৃপায় তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবি।’ মায়ের কথা শুনে জগন্নাথকে তিনি একমনে ডাকতে লাগলেন ও রাতে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। জগন্নাথদেব তাঁর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে তাঁর গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। দিনকয়েক কাটল। সাল বেগ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেন। মুসলমান হয়েও জগন্নাথদেবের ভক্ত হলেন। জগন্নাথকে নিয়ে সাল বেগ অনেকগুলি ভক্তিসংগীতও রচনা করেন। যা এখনও জনপ্রিয়।
এবার বলরাম দাসের গল্প বলি ? ‘পঞ্চসখা’-র অন্যতম বলরাম দাস ছিলেন জগন্নাথের ভক্ত। তবে তাঁর একটি বদগুণ ছিল। তিনি নিয়মিত এক বারাঙ্গনার বাড়িতে যেতেন। একবার রথযাত্রার সময় সোজা এক বারাঙ্গনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে জগন্নাথদেবের রথে ওঠার চেষ্টা করতেই পাণ্ডারা তাঁকে বাধা দেন। স্নানছাড়া অপরিষ্কার কাপড়ে তাঁকে রথে উঠতে দিতে চাননি পাণ্ডারা। অপমানিত বলরাম দাস বাঙ্কিমুহাণে গিয়ে সেখানে বালি দিয়ে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার তিনখানি রথ তৈরি করেন। এবং নিজের মনেই তিন বিগ্রহের পুজো করেন। এদিকে গ্র্যান্ড অ্যাভিনিউতে জগন্নাথদেবের রথ হঠাৎ আটকে যায়। রথ আর এগোয় না। সকলে ‘হায় হায়’ করে ওঠেন। সেদিন রাতেই পুরীর রাজা জগন্নাথদেবকে স্বপ্ন দেখলেন। প্রভু তাঁকে বলেছেন, ‘ওরে বলরাম আমার পরম ভক্ত। সে যে অবস্থায় থাকুক তাঁকে আমার রথে উঠতে না দিলে রথ আর এক পাও এগোবে না।’ পরদিন বলরাম দাসকে রাজা সসম্মানে নিয়ে এসে জগন্নাথদেবের রথে বসতে দিতেই অলৌকিক কাণ্ড ঘটল। রশিতে টান পড়া মাত্রাই রথ আবার চলতে শুরু করল। বলরাম দাস স্বয়ং এই গোটা ঘটনাটি ‘ভাবসমুদ্র’ নামে একটি ওড়িয়া কবিতায় লিখে গিয়েছেন।
পঞ্চাশোর্ধ্ব এক শিক্ষিতা মহিলা শিপ্রা মুখপাধ্যায় একটি মফস্বল স্কুলে পড়াতেন। জগন্নাথদেবের ভক্ত তিনি। অনেকদিন ধরেই তাঁর বিয়ের চেষ্টা চলছিল। ইতিমধ্যে শিপ্রার বাবা-মা দুজনেই মারা যান। তাঁর দু’ভাই বিদেশে কর্মরত। দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে। একা একটি বিরাট বাড়িতে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় দিন কাটছিল শিপ্রার। পুরীতে গিয়ে জগন্নাথের কাছে তিনি মানত করেন। মনের কোণে হয়তো বা ক্ষীণ আশা ছিল জগন্নাথ প্রভু মুখ তুলে চাইলে একদিন নিশ্চয়ই একাকিত্ব দূর হবে তাঁর। মানতে কাজ হয়েছিল শিপ্রার। এক বছরের মধ্যে অদ্ভুতভাবে মার্কিন মূলুকে বসবাসকারী এক বাঙালি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়ে হল তাঁর। শিপ্রা এখন নিউইয়র্কে বসবাস করেন। সম্প্রতি দেশে ফিরে পুরীতে যান। জগন্নাথদেবের পুজো-অর্চনা করেন। শিপ্রার এখন সুখের সংসার।
পা নেই অথচ সমস্ত জায়গায় যেতে পারেন। কান নেই অথচ সকলের কথা শুনতে পান। অপূর্ণ হাতেই এই জগৎ সংসারে এমন কোনও কাজ নেই যা তিনি করতে পারেন না। সমস্ত রস ভোগ করেন অনায়াসে। মুখে কোনও কথা নেই, কিন্তু তাঁর মতো বক্তা এই ব্রহ্মাণ্ডে কোথায় ? বিনা শরীরেই সবকিছু স্পর্শ করার ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। দেখতে পারেন সব কিছু-অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। ঘ্রাণ নেওয়ার শক্তি নেই কিন্তু বিশ্ব-সংসারের সমস্ত সুগন্ধ নেন। তিনি কে ? তিনি আর কেউ নন- শ্রীপুরুষোত্তম জগন্নাথ। তাঁর জন্যই পুরী কখনও পুরানো হয় না।