পূজা প্রচলন ও মূর্তি

অনঙ্গভীমদেব ৩য় চতুর ও শক্তিশালী রাজা ছিলেন। তাঁর বাবা রাজরাজা ৩য়-র রাজত্বকালে উড়িষ্যার মাটিতে আবার মুসলমান আক্রমণ নেবে আসে। উড়িষ্যার উত্তরাংশে আক্রমণ জোরদার হয়। রাজরাজা তৃতীয় এই আক্রমণ প্রতিহত করেন। সেইসময় ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খিলজি বঙ্গদেশের রাজধানী গৌড় অধিকার করলেন। শুধু গৌড় বা মগধ নয়, ভারতবর্ষের এক বিশাল এলাকা জুড়ে তখন হিন্দুধর্ম বিরাট সংকটের মুখে। এরকম সময়ে বহু হিন্দু উড়িষ্যায় গজপতি রাজার আশ্রয়লাভের আশায় পালিয়ে আসে। রাজরাজা ৩য়-র পরও উড়িষ্যায় মুসলমান আক্রমণ কমেনি। কিন্তু বারবার আক্রমণকারীরা পরাজিত হওয়ায় আক্রমণের ধার কমে আসে। উড়িষ্যার আপামর মানুষের বিশ্বাস প্রভু শ্রীজগন্নাথ দেবের অপার মহিমার জন্যই এই অঞ্চল বিধর্মী আক্রমণকারীদের হাত থেকে প্রায়শই রক্ষা পেয়েছে।

অনঙ্গভীমদেব ৩য়-র রাজত্বকালেই শ্রীপুরুষোত্তম জগন্নাথ প্রথম সরকারিভাবে সমগ্র উড়িষ্যা সাম্রাজ্যের জাতীয় দেবতারূপে স্বীকৃতি পান। তখন থেকেই শ্রীপুরুষোত্তমকে সাম্রাজ্যের প্রকৃত শাসনকর্তা বলে মনে করে এসেছেন এখানকার রাজারা। রাজ্যশাসনের ষষ্ঠ বছরে ১২১৬ খ্রিস্টাব্দে অনঙ্গভীমদেব ৩য় নিজেকে শ্রীপুরুষোত্তমের সহকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। শ্রীপুরুষোত্তম বলভদ্র ও সুভদ্রার পুত্র তিনিই। অনঙ্গভীমদেব ৩য়-র আর একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে শ্রীপুরুষোত্তমের পুত্র বলেই নিজেকে মনে করেন তিনি। উড়িষ্যার বর্তমান রাজধানী ভুবনেশ্বরে এই শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়। শিলালিপির তারিখ ১২৩০ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারি। কটকেও অনঙ্গভীমদেব ৩য় একটি জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ করেন।

মাদলাপাঁজি অনুযায়ী শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের প্রশাসনের কাজে একটা নিয়মনীতির সূচনা করেন ইনি। মন্দিরের ৩৬ রকমের সেবাকাজ তিনিই বলে দিয়ে যান। রাজবাড়িতে ৩৬ রকমের ক্রিয়াকর্ম হত। এবং সেখান থেকেই বুদ্ধিটা মাথায় আসে অনঙ্গভীমদেবের। তাঁর সময়েই পাণ্ডা ব্যবস্থার শুরু শ্রীপুরুষোত্তম মন্দিরে।

নীলমাধবের পুজো-অর্চনার দায়িত্ব কয়েকজন উপজাতি প্রধানকে দেওযা হয়। এঁরা ছিলেন শবর সম্প্রদায়ের। এঁরাই পাথরের মূর্তির পরিবর্তে কাঠের মূর্তি তৈরি করে তাঁর পুজো-অর্চনা শুরু করেন। অষ্টম শতাব্দীতে শবর হাত থেকে ভৌমকর রাজবংশ যখন মন্দিরটির দখল নেন তখন থেকেই জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারুমূর্তির পুজো শুরু। ডঃ হরেকৃষ্ণ মহতাব তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ ওড়িশা’ বইটির দ্বিতীয় খন্ডে বলেছেন ‘সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে উড়িষ্যার শবর সম্প্রদায়ের লোকজন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিল। পুরীতে একটি বৌদ্ধ¯তূপও গড়ে ওঠে। সেখানে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ-বৌদ্ধধর্মের এই ত্রি-রতেœর পুজো শুরু হয়। এবং এই ত্রিরত্নই হলেন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা। জগন্নাথ হলেন বুদ্ধদেব, ধর্ম ও সংঘের প্রতীক যথাক্রমে সুভদ্রা ও বলভদ্র। অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকেই জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার দারুমূর্তি পুজো প্রচলিত।’

জগন্নাথ বলভদ্র ও সুভদ্রার দারুমূর্তি উড়িষ্যার রাজা নরসিংহদেব ১ম-এর (১২৩৮-১২৬৪ খিস্টাব্দ) রাজত্বকালেই প্রথম পূজিত হন। এই তিন বিগ্রহের দারুমূর্তিরূপ উড়িষ্যার গোঁড়া ব্রাহ্মণরাও মেনে নেন। কারণ, তাঁরা বিশ্বাস করতেন জগন্নাথদেবের আত্মা বা ব্রহ্ম একটি অমূল্য শালগ্রামশিলা রূপে তাঁর দারুনির্মিত মূর্তির মধ্যেই লুকোনো রয়েছে। এবং এই মূর্তির বহিরঙ্গ উড়িষ্যার শবর উপজাতি পূজিত দারুমূর্তির কথা মনে করিয়ে দেয়।

আরও একটি কারণে জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা দারুমূর্তিরূপে পূজিত হতে লাগলেন। দেব-দেবীর বিগ্রহ নির্মাণতত্ত্ব অণুযায়ী এঁদের দারুমূতিরূপ পুজো অর্চনার যোগ্য। অগ্নিপুরাণ, মৎস্যপুরাণ ও ভাগবতপুরাণে সাতরকম পদার্থের যে কোনও একটি দিয়ে দেব-দেবীর মূর্তি নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এগুলোর অন্যতম হল দারু। এবং যেহেতু জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার মূর্তি তিনটি তুলনায় ভঙ্গুর পদার্থ বা দারুনির্মিত, তাই ‘নবকলেবর’ নামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিন বিগ্রহের নতুন দারুমূর্তি নির্মাণ করা হয়।

সাধারণ দারুমূর্তিতে যে কোনও সময়ে তাড়াতাড়ি ঘুণ ধরতে পারে। কিন্তু নিমকাঠের দীর্ঘদিন পরেও ঘুণ ধরায় সম্ভাবনা নেই। জগন্নাথদেবের নিমকাঠের বিগ্রহ নির্মাণের কথা সোমবংশীয় রাজা যযাতি কেশরীর মাথাতেই প্রথম আসে।

শ্রীপুরুষোত্তমের নাম শ্রীজগন্নাথদেব হল কবে থেকে ? রাজা ভানুদেব ২য়-র (১৩০৮-১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ) রাজত্বের সময় থেকেই রাজলিপিতে শ্রীপুরুষোত্তমকে শ্রীজগন্নাথদেব এই নতুন নামে ডাকা শুরু হয়। অর্থাৎ শক বৎসর ১২৩১ (১৩০৯ খ্রিস্টাব্দ) থেকে শ্রীজগন্নাথদেবের তৃতীয় শ্রাহি (অঙ্ক) বছর গোনা শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও চারদিকে নতুন করে প্রচার করা হতে থাকে যে শ্রীজগন্নাথদেবই হচ্ছেন উড়িষ্যা সাম্রাজ্যের একমাত্র অধীশ্বর। এবং তাঁর সুযোগ্য সেনাপতি হলেন ভানুদেব ২য়। অর্থাৎ ১২৪১ শক বৎসর (১৩১৯ খ্রিস্টাব্দ)। অতএব চতুর্দশ শতাব্দীর একেবারে গোড়া থেকেই শ্রীজগন্নাথদেবের শ্রাহি বছর গোনা শুরু হয়েছিল।