গড়ুক সেবক, সন্ধ্যাধূপ ও নীলচক্র
প্রতাপরুদ্রদেবের পর উড়িষ্যার রাজা হন তাঁর মন্ত্রী গোবিন্দ বিদ্যাধর। প্রতাপরুদ্রদেবের ছেলেদের একে একে হত্যা করেন গোবিন্দ বিদ্যাধর। তারপর উড়িষ্যার রাজা হয়ে বসলেন। গোবিন্দ বিদ্যাধর ও তাঁর ছেলে চক্র প্রতাপের সময়ে শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের কোনও উন্নতিই হয়নি। মাদলাপাঁজি অনুযায়ী চক্রপ্রতাপ ছিলেন এক অপদার্থ রাজা। এরপর আরও দু-একজন দুর্বল রাজা উড়িষ্যা শাসন করলেও ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার সিংহাসনে বসলেন দক্ষিণ ভারতের চালুক্যবংশের মুকুন্দদেব হরিচন্দন।তাঁকে ‘তেলেঙ্গা মুকুন্দ’ বলা হত। জগন্নাথদেবের ভক্ত ছিলেন মুকুন্দদেবও। তিনি যুদ্ধবিগ্রহে বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকলেও শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের উন্নতিকল্পে প্রচুর সোনা-দানা ও ভূসম্পত্তি দান করেন। ‘জগমোহনে’র কিছু কিছু উন্নতিও করেছিলেন। মন্দির শিখরে ‘নীলচক্র’ তিনিই প্রথম স্থাপন করেন। এই নীলচক্রটি অষ্টধাতুতে তৈরি। এর উচ্চতা ১১ ফুট ৮ ইঞ্চি। ব্যাস ৭ ফুট ৭ ইঞ্চি। ভগবান বিষ্ণুর সবথেকে শক্তিশালী অস্ত্র সুদর্শন চক্রেরই প্রতিরূপ নীলচক্র। এই নীলচক্রে দুটি চাকা। মোট আটটি চক্রনাভি নীলচক্রের ভেতর ও বাইরের চাকাদুটিকে যুক্ত করেছে।
পরম্পরা অনুসারে নীলচক্রে পবিত্র পতাকা না থাকলে জগন্নাথের ভোগ হতে পারে না। সেজন্য জল-ঝড় যা-ই হোক প্রতিদিন একজন গড়ুক সেবক মন্দিরের উপরে উঠে পতাকা বাঁধেন। এটি সন্ধেবেলায় বাঁধা হয়। ভক্তরা নিজের মানসিক অনুযায়ী সেই সেবককে দিয়ে পতাকা বাঁধাতে পারেন। ছোট-বড় বিভিন্ন আকৃতির তিন-চারটি রঙিন পতাকা বাঁধা হয়। পতাকার নাম ‘পতিতপাবন বানা’ ব্রহ্মপুরাণে (৯০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত ) এই নীলচক্রটি অত্যন্ত পবিত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কখনও কখনও কোনও কারণে জগন্নাথদেবের উদ্দেশে শুকনো ভোগ নীলচক্রকে সমর্পণ করা হয়। এবং তা মহাপ্রসাদে পরিণত হয়। একে ‘চক্রমনোহি’ বলে। প্রত্যেক একাদশীতে সন্ধ্যাধূপের পর মন্দির শিখরে নীলচক্রের তলদেশে গড়ুক সেবক মাটির এক ফুট লম্বা-চওড়া আড়াই কিলো ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। এই প্রদীপকে ‘মহাদীপ’ বলে। অদ্ভুত ব্যাপারে প্রচন্ড বাতাসেও সাধারণত সেই প্রদীপ নেভে না।
গড়ুক সেবক কাকে বলে ? সন্ধ্যাধূপই বা কী ? শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে যেসব ব্রহ্মণসেবক বিভিন্ন সেবাকাজে নিযুক্ত থাকেন তাঁদের মধ্যে থেকেই দু-চারজন বিষ্ণুর বাহন গড়ুরের সেবা করেন। নাটমন্দিরের গড়ুর স্তম্ভের পুজো-অর্চনা করেন তাঁরা। এঁদেরই গড়ুক সেবক বলে। আর সন্ধ্যাধূপ হল জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার সন্ধ্যাপুজো।
নীলচক্র প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়ে রাখি। রাজা মুকুন্দদেব স্থাপিত ষোড়শ শতাব্দীর সেই নীলচক্রটি কিন্তু আজকের এই নীলচক্র নয়। বেশ কয়েকবার প্রচন্ড ঝড়ে মন্দির শিখরের নীলচক্র উড়ে গেছে। নতুন নীলচক্র দ্রুত যথাস্থানে আবার বসানো হয়েছে।